এফ-কমার্স ব্যবসা কিভাবে শুরু করবেন
ইন্টারনেট ভিত্তিক এই যুগে ই-কমার্স (E-Commerce) এর সঙ্গে মোটামুটি আমরা প্রায় সবাই কম বেশি পরিচিত। ই-কমার্স হলো ইন্টারনেটের মাধ্যমে ব্যবসা করার একটি ভার্চুয়াল সিস্টেম বা প্রক্রিয়া। ওয়েবসাইট , ওয়েবপেজে , ইউটিউব চ্যানেল বা ফেসবুকের মাধ্যমেও এখন ই-কমার্স করা যায়। কিভাবে এফ-কমার্স ব্যবসা শুরু করবেন ?
বন্ধুরা! অবাক হচ্ছেন বুঝি? অবাক হওয়ার কিছু নেই। হ্যাঁ! আপনি ফেসবুকের মাধ্যমে এখন ব্যবসা করতে পারেন। একে বলা হয় এফ-কমার্স (F-Commerce) বা ফেসবুক কমার্স। যা ই-কমার্সের একটি পার্ট বা অংশ।
চলুন কয়েকটি ছোট উদাহরণের সাহায্যে বুঝিয়ে বলছি এফ-কমার্স কি ও ব্যবসা কিভাবে করবেন।
সিয়াম সদ্য স্নাতক পাশ করে বেড়িয়েছে। ফেসবুকে বন্ধুদের সাথে গল্প করে ও ভিডিও দেখে অনেক সময় নষ্ট করে ফেলে। কিন্তু তার এই বেকার জীবন আর ভালো লাগে না। হঠাৎ একদিন সে ফেসবুকে কয়েকটি পেজ দেখে যারা ফেসবুক ব্যবসা করে। ব্যাপারটা সিয়ামের খুব ভালো লাগে এবং সেও এফ-কমার্স করার কথা চিন্তা করে। সে পাইকারি দরে ভালো মানের শাড়ি ও থ্রি-পিস ক্রয় করে ফেসবুক পেজের মাধ্যমে খুচরা দরে বিক্রি করে। পেজের মধ্যে সে তার পণ্যের ছবি , দাম , সার্ভিস ও পেমেন্ট মেথড উল্লেখ করে পোস্ট দেয় এবং সেখান থেকেই তার পণ্যের সেল হয়।
মনিকা একজন গৃহিণী। তার স্বামীর হঠাৎ অসুস্থতায় তাঁদের আর্থিক অবস্থা অচল হয়ে পড়ছে। সে তার এক বান্ধবীর সাথে আলাপ করলে সে তাকে এফ-কমার্সের কথা বলে। মনিকা ভাবে সে খুব ভালো নকশি কাথা সেলাই করতে পারে। তাই সে ফেসবুকে একটি ব্যবসায়িক পেজ খোলে এবং অবসর সময়ে নকশি কাথাঁ সেলাই করে সেসব কাথাঁর ছবি দামসহ উল্লেখ করে পেজে পোস্ট করে। কিছুদিনের মধ্যেই সে খুব ভালো সারা পেতে শুরু করে। এখন মনিকা তার এলাকার কিছু অসহায় নারীকেও তার কাজের সঙ্গী করে নিয়েছে এবং সে একজন এফ-কমার্স ব্যবসায়ী হিসেবে সুপরিচিত।
মৃদুল খুব ভালো ডেকোরেশন করতে পারে। একসময় সে তার মামার সাথে গ্রামের বাড়িতে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের ডেকোরেশনে যেত এবং ভালো কাজের জন্য অনক প্রশংসিত হতো। একসময় মৃদুল তার ক্যারিয়ার নিয়ে অনেক চিন্তিত হয়ে পরে। এরপর ইন্টারনেটে অনেক ঘাটাঘাটি করে এফ-কমার্সের ব্যাপারে জানতে পারে। পরে সে ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট এর জন্য একটি ফেসবুক পেজ খোলে এবং বিজ্ঞাপন প্রচার শুরু করে। এখন মৃদুল বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট এর জন্য কাজ পেতে থাকে এবং এখন তার একটি ছোটখাটো অফিস রয়েছে।
মিনু বাগেরহাট জেলার একটি ছোট গ্রামে বাস করে এবং সে ইন্টারমিডিয়েট এর একজন ছাত্রী। দরিদ্র পরিবারের সন্তান হবার কারণে লেখাপড়ার খরচ চালাতে তাকে হিমশিম খেতে হয়। একসময় সে তার বান্ধবীকে অনলাইনে ব্যবসা করতে দেখে। সে এ ব্যাপারে বিস্তারিত জানতে পেরে সেও এফ-কমার্স করতে আগ্রহী হয়ে ওঠে। সে তার বান্ধবীর সহায়তায় সুন্দরবনের মধু নিয়ে এফ-কমার্স ব্যবসা শুরু করে। এখন তার সরবরাহকৃত মধু বাংলাদেশের প্রতিটি জেলায় পৌঁছে যায় এবং লেখাপড়ার খরচ চালানোর পাশাপাশি পরিবারেরও ভাড় বহন করতে পারে।
এই উদাহরণগুলি এখন কেবল একজন সিয়াম , মনিকা , মৃদুল বা মিনুর নয়। বর্তমানে বাংলাদেশে অসংখ্য তরুণ-তরুণী এফ-কমার্স ব্যবসার মাধ্যমে নিজেদের ক্যারিয়ার সমৃদ্ধ করছে ও স্বাবলম্বী হচ্ছে।
সুতরাং আজকে থেকে আপনি ও শুরু করতে পারেন এফ-কমার্স ব্যবসা ও বেকারত্ব দূর করে হতে পারেন স্বাবলম্বী। তাই আপনাকে প্রথমে জানতে হবে কিভাবে এফ-কমার্স ব্যবসা শুরু করবেন। তো চলুন দেখে নেই কি কি উপায় অবলম্বন করে আপনি এফ-কমার্স ব্যবসা শুরু করতে পারেন ও সাফল্য অর্জন করতে পারেন।
ব্যবসা শুরুর পূর্বে যেগুলো মনে রাখবেন
প্রিয় পাঠকবৃন্দ! আপনি চাইলে হুট করেই একটি এফ-কমার্স ব্যবসা শুরু করতে পারবেন না বা এর দ্বারা সফল হতে পারবেন না। এজন্য আপনাকে হতে হবে ধৈর্যশীল ও কৌশলী। এক নজরে দেখে নিন ব্যবসা শুরু পূর্বে যে বিষয়গুলো মাথায় রাখবেন:
- ১. প্রথমে আপনার এলাকা বা শহর বা দেশের মধ্যে যে সকল পণ্যের চাহিদা সবথেকে বেশি সেগুলো চিহ্নিত করুন। অথবা আপনার দক্ষতা খুঁজে বের করুন। যেমন ধরুন আপনি খুব ভালো বেকিং এর কাজ জানেন। সুতরাং আপনি হোম মেড কেক বা বিস্কুট তৈরি করে বিজনেস করতে পারেন।
- ২. সবগুলো পণ্যের মধ্য থেকে নির্দিষ্ট কোনো একটি পণ্য বাছাই করুন।
- ৩. এবার বোঝার চেষ্টা করুন ফেসবুক ব্যবহারকারীদের মধ্যে আপনার পণ্যের চাহিদা কেমন হবে। যেমন- শিশু কিংবা বয়স্কাদের তুলনায় তরুণ-তরুণীরা ফেসবুকে বেশি সক্রিয় আবার নারীর চেয়ে পুরুষ ব্যবহারকারীর সংখ্যা বেশি। সুতরাং তাদের চাহিদা অনুযায়ী পণ্য বাছাই করুন। তবে সাধারণত নারী ও শিশুর পণ্যের চাহিদা বেশি থাকে।
- ৪. আকর্ষণীয় , ব্যতিক্রমধর্মী , মানসম্মত ও ট্রেন্ডিং পণ্য বেছে নিন।
- ৫. নির্দিষ্ট কিছু এলাকা বা অঞ্চল ঠিক করুন যেখানে আপনার পণ্য বা সেবা পৌঁছে দিতে পারবেন।
- ৬. আপনি কি ধরনের ডেলিভারি প্রদান করবেন তা ঠিক করুন। কুরিয়ারে সার্ভিস দিলে আপনার লোকাল কুরিয়ার অফিসে যোগাযোগ করে রাখুন।
- ৭. এফ-কমার্স সংক্রান্ত সকল প্রয়োজনীয় তথ্যাদি জানার চেষ্টা করুন।
- ৮. অতঃপর একটি ফেসবুক বিজনেস পেজ কিভাবে ওপেন করতে হয় তা শিখুন।
ব্যবসা শুরুর পরে যা করবেন
ব্যবসা শুরু করে রাতারাতি আপনি পরিচিতি লাভ করতে পারবেন না বা পণ্যের সেল পাবেন না। এর জন্য আপনাকে যেমন ধৈর্যশীল হতে হবে তেমনি হতে হবে অনেক পরিশ্রমী। কেননা পরিশ্রম ব্যতীত সফলতা অর্জন করা সম্ভব নয়। তাই এফ-কমার্স ব্যবসা শুরুর পরে আপনাকে অনেক কৌশলী ও পরিশ্রমী হতে হবে। সুতরাং চলুন যে বিষয়গুলোর ব্যাপারে আপনাকে সচেতন হবে সেগুলো জেনে নেই।
- প্রথমে ফেসবুকে একটি বিজনেস পেজ তৈরি করুন এবং ব্যবসার সাথে সামঞ্জস্য পূর্ণ একটি নাম দিন।
- ফেসবুক পেজটিকে আকর্ষণীয়ভাবে সেট করুন। যেন তা সহজেই মানুষকে আকৃষ্ট করতে পারে।
- পেজে আপনার পণ্য ও সার্ভিস সংক্রান্ত সকল তথ্য সুন্দরভাবে উপস্থাপন করুন।
- প্রথমে আপনার পেইজে ফলোয়ার্স বাড়ানোর চেষ্টা করুন। কারণ পেজের ফলোয়ার্সরাই হবে আপনার পণ্যের ক্রেতা। আর ফলোয়ার্স বাড়লে অটোমেটিক পেজে লাইক কমেন্ট বাড়বে ও পণ্যের মার্কেটিং হবে।
- পেজে ফলোয়ার্স বাড়াতে প্রথমে বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে শেয়ার করুন। পাশাপাশি পেজে আকর্ষণীয় ও উপকারী কিছু পোস্ট করতে পারেন। যেমন- এফ-কমার্স সম্পর্কিত কিছু আর্টিকেল পোস্ট করতে পারেন। এসব আর্টিকেল মানুষের কাজে আসবে বলে সবাই আপনার পেজটি ফলো করতে শুরু করবে।
- পেজে যথেষ্ট পরিমাণ ফলোয়ার্স জমা হলে আপনার পণ্যের ছবিসহ পোস্ট করুন। পণ্যের কার্যকারিতা ও অন্যান্য গুণাবলি উপস্থাপন করুন।
- যেহেতু আপনার দোকান ভাড়া ও পরিবহন খরচ প্রায় নেই বললেই চলে সেহেতু অপেক্ষাকৃত কম দামে পণ্যের প্রচার করুন।
- পেইজে প্রতিটি কমেন্ট এ দ্রুত ও সঠিক সময়ে সুন্দরভাবে উত্তর প্রদান করুন।
- পণ্যের ব্রান্ডিং আকর্ষণীয়ভাবে করুন এবং যথাসময়ে পণ্য পৌঁছে দিন গ্রাহকের ঠিকানায়।
- পণ্যের মান বজায় রাখুন যাতে আপনি ও আপনার পণ্যের উপর সকলের আস্থা গড়ে ওঠে।
- ধীরে ধীরে পণ্যের মার্কেটিং বাড়ান। প্রয়োজনে পেইড মার্কেটিং করার চেষ্টা করুন।
- নিজস্ব ওয়েবসাইট বা ইউটিউব চ্যানেল তৈরি করুন।
- সর্বোপরি পণ্যের মার্কেটিং এর জন্য প্রয়োজনীয় সকল ব্যবস্থা গ্রহণ করুন
তো বন্ধুরা! আশা করি কিভাবে এফ-কমার্স ব্যবসা শুরু করবেন সে ব্যাপারে সম্পূর্ণ ধারণা দিতে পেরেছি। সুতরাং আর দেরি না করে শুরু করে দিন এফ-কমার্স ব্যবসা এবং বেকারত্বের অভিশাপ থেকে বেড়িয়ে নিজেকে স্বাবলম্বী করে গড়ে তুলুন।
ধন্যবাদ।