চ্যাটবট Chatbot কি?চ্যাটবট এর উপকার ও অপকার
অনলাইনে ব্যবসা বাণিজ্যের প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে সমানুপাতিক হারে বেড়ে চলেছে বিভিন্ন ম্যাসেঞ্জার সাইটগুলোর ব্যবহার। বিভিন্ন রিসার্চে উঠে এসেছে এখন মানুষ পণ্য ক্রয় বিক্রয় করতে ওয়েবসাইট এর সাহায্য নেয়ার চেয়ে সরাসরি ম্যাসেজিং করতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। যার ফলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর চেয়ে মানুষ ম্যাসেঞ্জার সাইটগুলো যেমন- Fb ম্যাসেঞ্জার (FB messenger) , এসএমএস (SMS), সিরি (Siri) , স্কাইপি (Skype) , ওয়েচ্যাট (Waychat) প্রভৃতি বেশি ব্যবহার করে।
তাই এসব সাইটে ব্যবহারকারীদের সেবা গ্রহণে আরও অধিক স্বাচ্ছন্দ্য প্রদানে প্রযুক্তিবিদ ও প্রোগ্রামার Michael Maudlin- এর অবিশ্বাস্য এক আবিষ্কারের নাম চ্যাটবট (Chatbot). চ্যাটবট ব্যবহারের অবর্ণনীয় ইতিবাচক দিকগুলো এর জনপ্রিয়তা ও ব্যবহারকে নিয়ে গিয়েছে এক অনন্য উচ্চতায়। একটি সমীকরণে উঠে এসেছে গত দুই বছরে প্রায় তিন লক্ষ চ্যাটবট বিভিন্ন ম্যাসেঞ্জার সাইটগুলোতে যুক্ত হয়েছে।
তাই চ্যাটবট এর এই জনপ্রিয়তার কারনে এখন অনেকেই এর সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে ও ব্যবহার করতে আগ্রহী। কিন্তু এখনও বেশিরভাগ মানুষ চ্যাটবট এর বিভিন্ন দিকগুলো সম্পর্কে জানেন না। তাই আপনাদের জানার সুবিধার্থে আজকের আর্টিকেলটিতে থাকছে চ্যাটবট কি ও চ্যাটবট এর উপকারিতা ও অপকারিতা সম্পর্কে নানা গুরুত্বপূর্ণ তথ্যাদি।
চ্যাটবট কি (What is a chatbot)
চ্যাটবট হলো এক ধরনের কম্পিউটার প্রোগ্রাম বা সফটওয়্যার যা আর্টিফিশিয়্যাল ইনটেলিজেন্স (AI) বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে গঠন করা হয়। অর্থ্যাৎ এটি এমন এক ধরনের চ্যাট ইন্টারফেস যেখানে আগে থেকেই প্রোগ্রামিং এর সাহায্যে বিভিন্ন তথ্য যুক্ত করা হয়। যেগুলোর মাধ্যমে সে পরবর্তীতে মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করতে পারে।
প্রধানত ম্যাসেঞ্জার অ্যাপ্লিকেশন গুলোতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে স্বয়ংক্রিয়ভাবে মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের জন্য চ্যাটবট ব্যবহার করা হয়। আক্ষরিক অর্থে চ্যাটবট শব্দের মানে হলো কৃত্রিম আলাপচারিতা। চ্যাটবট একজন মানুষের মতোই অপর একজন মানুষের সাথে চ্যাটিং (Chatting)করে তথ্য আদান প্রদান করতে পারে।
যার ফলে বিভিন্ন অনলাইন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গুলোতে চ্যাটবট এর ব্যবহার লক্ষণীয় এবং ক্রমশ এর হার অনেক উচ্চহারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। কেননা এর মাধ্যমে ম্যাসেজ অপশনে কাস্টমারের সাথে স্বয়ংক্রিয়ভাবে তথ্য আদান প্রদান করে থাকে। ফলে প্রতিষ্ঠানের কাজ যেমন সহজ হয়ে যায় তেমন সময় অনেক সাশ্রয় হয়। যেমন- কাস্টমারেরা সবসময়ই ম্যাসেঞ্জারে বিভিন্ন ধরনের প্রশ্ন করে থাকে বা কোনো না কোনো তথ্য জানতে চান। সারাক্ষণ এসব প্রশ্নের উত্তর প্রদান করতে করতে একজন মানুষ সহজেই হাপিয়ে ওঠে এবং সময় অনেক লস হয়। তাই চ্যাটবট এর মধ্যে এসব প্রশ্নের উত্তর আগেই সংযুক্ত করা হয় এবং পরবর্তীতে কাস্টমার যখন কোনো প্রশ্ন করে থাকে তখন চ্যাটবট স্বয়ংক্রিয়ভাবে সেসব প্রশ্নের সঠিক উত্তর প্রদান করে।
চ্যাটবট কিভাবে কাজ করে (How does a chatbot work)
চ্যাটবট প্রধানত দুটি উপায়ে কাজ করে থাকে। একটি হলো ফাংশনাল সিস্টেম ও অপরটি হলো মেশিন লার্নিং সিস্টেম। এখন পর্যন্ত বিভিন্ন ম্যাসেঞ্জার চ্যানেল গুলোতে এই দুই ধরনেরই চ্যাটবট দেখা যায়।
বন্ধুরা! এখন চলুন জেনে নেয়া যাক কোন চ্যাটবট কিভাবে কাজ করে সে সম্পর্কে।
ফাংশনাল চ্যাটবট
ফাংশনাল চ্যাটবট গুলো মূলত কম বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন এবং কিছুটা নরমাল ধরনের চ্যাটবট। এই ধরনের চ্যাটবট গুলো কিছু নির্দিষ্ট তথ্য দিয়ে ডিজাইন করা হয়। অর্থাৎ একজন প্রোগ্রামার ঠিক যেসব তথ্য বটে আগে সেট করে দেবে , একটি চ্যাটবট কেবলমাত্র সেই তথ্যগুলো ব্যবহার করতে পারবে। মানে নিজে থেকে কোনো তথ্য তৈরি করা বা প্রদান করা এই ধরনের চ্যাটবট গুলোর পক্ষে সম্ভব হয় না।
মেশিন লার্নিং চ্যাটবট
মেশিন লার্নিং চ্যাটবট গুলো হলো আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন। ফলে এরা কথা বলার সময় অপরের মনোভাব বুঝতে পারে এবং সে অনুযায়ী যথাযথ উত্তর দিতে পারে। তাই মেশিন লার্নিং চ্যাটবট গুলো এতোটাই বাস্তবিক হয় যে কথা বলার সময় কেউ বুঝতেই পারবে না যে সে একটি মেশিনের সাথে কথা বলছে। মনে হবে যে সে একজন মানুষের সাথে কথা বলছেন।
চ্যাটবট এর উপকারিতা ও অপকারিতা (Advantages and disadvantages of a chatbot)
প্রধানত চ্যাটবট এর মূল প্রয়োগ হলো ব্যবসা ক্ষেত্রে। ব্যবসায়িক কাজে চ্যাটবট এক অপার সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিয়েছে। এর নানামুখী ইতিবাচক দিকসমূহ ব্যবসায়িক কাজকে আগের তুলনায় করে দিয়েছে অনেক সহজ , সরল , প্রাণবন্ত ও আকর্ষণীয়।
তো বন্ধুরা! এবার আলোচনা করা যাক চ্যাটবট এর উপকারী দিক গুলো নিয়ে।
উপকারী দিকসমূহ:
১. গ্রাহকের অন্তর্দৃষ্টি সংগ্রহ (Gather Customer Insights)
চ্যাটবট আপনার গ্রাহকদের সাথে আলাপচারিতার মাধ্যমে তাদের বিভিন্ন তথ্যাদি আপনাকে প্রদান করতে পারে। যেমন- গ্রাহকের ক্রিয়াকলাপ , আপনার কাজ সম্পর্কে তাদের মতামত , পছন্দ-অপছন্দ এবং আরও অনেক কিছু।
এর মাধ্যমে এসব তথ্যের উপর ভিত্তি করে কাস্টমারের কমন প্রশ্নগুলো সম্পর্কে অবহিত হওয়া যায় এবং এসব প্রশ্নের উত্তর ওয়েবসাইটে পরবর্তীতে যুক্ত করা যায়।
তাছাড়া গ্রাহকের সমস্যা সম্বন্ধে জানা যায় এবং সমস্যা সমাধানে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহন করা যায়।
২. মার্কেটিং এর মাধ্যমে বিক্রয় বৃদ্ধি (Increase Sales by Marketing)
চ্যাটবট শুধুমাত্র কাস্টমারের সাথে আলাপচারিতার জন্য ব্যবহার করা হয় না। চ্যাটবট কোম্পানির জন্য পণ্যের মার্কেটিং করতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। নতুন নতুন পণ্যের প্রমোশন ও আপডেট কাস্টমারের নিকট সরাসরি পৌঁছে দিতে চ্যাটবট একজন মানুষের মতো কাজ করতে পারে। তাছাড়া এভাবে মার্কেটিং মাধ্যমে পণ্যের বিক্রয় বৃদ্ধি করতে চ্যাটবট আপনার কোম্পানির জন্য আলোর দিশারী হতে পারে।
৩. ২৪/৭ সার্ভিস প্রদান ( Gives Service 24/7)
বন্ধুরা! এটি একটি বাস্তব সত্য কথা যে একজন মানুষের পক্ষে প্রতিদিন ২৪ ঘন্টা বিরতিহীনভাবে সার্ভিস প্রদান করা অসম্ভব। কিন্তু এই অসম্ভবকে সম্ভব করেছে চ্যাটবট। কেননা চ্যাটবট কোনো মানুষ নয়। এটি এক প্রকার যন্ত্র এবং এটি প্রতিদিন ২৪ ঘন্টা বিরতিহীনভাবে আপনাকে সার্ভিস প্রদান করতে সক্ষম। ফলে আপনার অফিশিয়াল কার্যক্রম যদি বন্ধ হয়ে যায় তবুও চ্যাটবট আপনার কাস্টমারকে ২৪ ঘন্টার মধ্যে যেকোনো সময় সেবা দিতে প্রস্তত।
৪. ব্যবসার খরচ কমায় (Decreases Cost for Business)
চ্যাটবট ব্যবহারের অন্যতম উপকারী যে দিকটি তা হলো চ্যাটবট ব্যবসায় খরচ কমাতে সাহায্য করে। কেননা প্রতি মাসে প্রতিষ্ঠানে কর্মরত কাস্টমার সার্ভিস টিমকে একটি মোটা অংকের টাকা বেতন হিসেবে দিতে হয়। কিন্তু চ্যাটবট ব্যবহার করলে এসব খরচের পুরোটাই লাঘব করা সম্ভব হয়।
তাছাড়া ব্যবসার পরিধি যত বড় হবে কাস্টমার সার্ভিসে তত বেশি কর্মকর্তা নিয়োগ দিতে হবে। অপরদিকে চ্যাটবট এর ক্ষেত্রে শুধুমাত্র এর প্রোগ্রাম সেট করার জন্য কিছু টাকা ও শ্রম ইনভেস্ট করতে হয়। কিন্তু একটি চ্যাটবট একবার তৈরি হয়ে গেলে তা অনেক দীর্ঘ সময় সার্ভিস প্রদান করতে সক্ষম। তা ব্যবসার পরিধি যত বড়ই হোক না কেন।
৫. কাস্টমার সন্তুষ্টি অর্জন করতে সক্ষম (Able to Gather Customer Satisfaction)
একটি প্রতিষ্ঠানে কাস্টমার কেয়ার সেকশনে যে সকল কর্মকর্তাবৃন্দ যুক্ত থাকেন তাদের প্রায় কেউই বহু ভাষায় পারদর্শী হন না বা হতে পারেন না। কিন্তু অনেক সময় দেখা যায় ভিনদেশি কোনো কাস্টমার আপনার প্রতিষ্ঠানের সেবা গ্রহণ করতে ইচ্ছুক। অথচ আপনার কর্মকর্তা ও কর্মচারীবৃন্দ ভাষা না জানার ফলে সেবা প্রদানে ব্যর্থ হয় এবং কাস্টমার অসন্তুষ্ট হন।
অপরপক্ষে আপনি একটি চ্যাটবট এ বহু ভাষায় প্রোগ্রাম সেট করে প্রশিক্ষণ দিয়ে নিতে পারেন। ফলে চ্যাটবট যেকোনো ভাষায় যেকোনো মানুষের সাথে ভাব বিনিময় ও প্রয়োজনীয় সেবা দিতে পারে।
অপকারি দিকসমূহ:
বন্ধুরা! আমরা প্রায় সবাই জানি যে প্রতিটি জিনিসেরই একটি ইতিবাচক ও একটি নেতিবাচক দিক থাকে। তাই চ্যাটবট এর ব্যতিক্রম নয়। চ্যাটবট এরও কিছু নেতিবাচক বা অপকারী দিক রয়েছে। যেমন-
১. আবেগের অভাব (Lack of Emotions)
একজন মানুষের আবেগ থাকবে সেটা স্বাভাবিক। কিন্তু চ্যাটবট যেহেতু এক প্রকার যন্ত্র এর আবেগ থাকা অসম্ভব।
একটি ফাংশনাল বটের ইনপুট এ আপনি যতখানি তথ্য প্রদান করবে সে ঠিক ততখানি তথ্যই পড়তে পারবে এবং ব্যবহার করতে পারবে। কিন্তু যেহেতু মানুষের মুড এর পরিবর্তন ঘটে তাই যেকোনো মুহূর্তে কাস্টমারের যেকোনো প্রশ্নের উত্তর চ্যাটবট দিতে ব্যর্থ হবে যদি না তার উত্তর ইনপুট এ সেট না করা থাকে।
তবে সৌভাগ্যের বিষয় এটাই যে AI বা আর্টিফিশিয়্যাল ইনটেলিজেন্স যুক্ত চ্যাটবট ব্যবহারে এই সমস্যা থেকে বেড়িয়ে আসা যায়। কেননা এ সকল চ্যাটবট মানুষের ভাব বুঝতে ও সে অনুযায়ী উত্তর তৈরি করতে অনেকাংশেই সফল।
২. তৈরি করা কঠিন (Difficult to Create)
হ্যাঁ , বন্ধুরা! একটি চ্যাটবট তৈরি করা সত্যিই খুব কঠিন কাজ। আপনি চাইলে সফল ভাবে এটি তৈরি করে নিতে পারবেন না। এর জন্য অবশ্যই আপনার প্রোগ্রামিং সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান থাকতে হবে এবং যথেষ্ট পরিমাণ প্রশিক্ষণ থাকতে হবে।
তাছাড়া একটি চ্যাটবট তৈরি করতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ সময় এবং এফর্ট এর প্রয়োজন হয়। আর একজন ভালো প্রোগ্রামার ছাড়া একটি ভালো চ্যাটবট তৈরি করা সম্ভব নয়।
৩. জটিল প্রশ্নত্তরে ব্যর্থ (Failed to Answer for Complex Questions)
একটি চ্যাটবট এর সবথেকে বড় নেতিবাচক দিকের কথা যদি বলি তবে তা হলো একটি চ্যাটবট কিছু সাধারণ প্রশ্নের উত্তর দিতে সক্ষম। কোনো প্রকার জটিল প্রশ্নের উত্তর চ্যাটবট দিতে পারে না। এর জন্য অনেক সময় অনেক বিড়ম্বনায় পরতে হয়।
৪. প্রচুর পরিমাণে প্রশিক্ষণের প্রয়োজন (Need a lot of Training)
একটি চ্যাটবট কে সর্বদা সচল রাখতে এবং কাস্টমারের সঙ্গে সর্বাবস্থায় ভাব বিনিময় করতে একে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন প্রশিক্ষণ দিতে হয়।
কেননা একজন কাস্টমার সবসময় একই ধরনের কথাবার্তা বলবেন না বা সকল কাস্টমারের কথা কখনও এক হবে না। তাই সবধরনের প্রশ্নের উত্তর প্রদানে সক্ষম করার জন্য একটি চ্যাটবট কে প্রশিক্ষণ দিয়ে রাখতে হয়।
আমাদের শেষ কথা (Our Final Thoughts)
একটি চ্যাটবট এর যেমন অনেক উপকারিতা রয়েছে তেমনি অনেক অপকারিতাও রয়েছে। তবে এর অতি প্রয়োজনীয় সকল উপকারিতা এর অপকারিতা গুলোকে ছাপিয়ে যায়।
সঠিক দিকনির্দেশনা ও প্রশিক্ষণ প্রদান করলে চ্যাটবট আপনার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনীয় অনেক সময় , টাকা ও শ্রম সেইভ করতে সক্ষম।
ট্রেনিং সেকশনের সঠিক ব্যবহারের ফলে চ্যাটচটের সমস্যা গুলো থেকে বেড়িয়ে আসা সম্ভব হয়। অর্থ্যাৎ নিয়মিত যদি চ্যাটবট কে সঠিক প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় তবে একটি চ্যাটবট এর কার্যক্ষমতা বহুলাংশে বৃদ্ধি পেতে থাকবে।